বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:২৯ অপরাহ্ন
মুহাম্মদ আব্দুল বাছির সরদার : অবশেষে সুনামগঞ্জের মানুষের দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে উদ্বোধন হলো সুরমা নদীর উপর নির্মিত ‘আব্দুজ জহুর’ সেতুর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেতুটির উদ্বোধন ঘোষণা করেন। বৃহস্পতিবার (২০ আগস্ট) বেলা ১১টায় সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স আয়োজন করা হয়। দুপুর ১২টায় গণভবনে বসে সেতুর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, দেশের উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চল বেশি অবহেলিত হয়ে আছে, উন্নয়ন প্রয়োজন। এই সেতুগুলো এসব অঞ্চলের মানুষের উপকারে আসবে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে সেতু মানুষের যাতায়তকে সহজ করার পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও পর্যটন শিল্পের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে এ সময় উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও বলেন, সিলেট অঞ্চলের যোগাযোগ অবকাঠামো নির্মাণে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ঢাকা-সিলেট সড়ক চার লেনে উন্নীত করা হবে। সুনামগঞ্জ জেলার যোগাযোগ অবকাঠামো আরো উন্নয়ন করা হবে। যাতে করে এ অঞ্চলের মানুষের জীবন-মানের উন্নয়ন ঘটে।
গণভবনে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, মন্ত্রণালয়রে সচিব, বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূতসহ সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। মন্ত্রণালয় জানায়, বাংলাদেশ সরকার ও জেডিসিএফ-এর অর্থায়নে সুনামগঞ্জে সুনামগঞ্জ-কাঁচিরগাতি-বিশ্বম্ভরপুর সড়কে সুরমা নদীর উপর সেতু নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় ৭১.১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪০২.৬১ মিটার আব্দুজ জহুর সেতুটি নির্মাণ করা হয়। সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে এ সময় উপস্থিত ছিলেন অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান এমপি, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব চন্দন কুমার দে, সংসদ সদস্য মহিবুর রহমান মানিক, মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ, জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলাম, জেলা আওয়ামীলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আলহাজ্ব মতিউর রহমান, জেলা পরিষদের প্রশাসক ব্যারিস্টার এম এনামুল কবীর ইমন, সিভিল সার্জন ডা: মো: আব্দুল হাকিম, পুলিশ সুপার হারুন-অর-রশীদ, জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জর্জেচ মিয়া, সড়ক ও জনপথ (সওজ)-এর নির্বাহী প্রকৌশলী আনোয়ারুল আমীন, মরহুম আব্দুজ জহুরের জেষ্ঠ্য ছেলে আওয়ামীলীগ নেতা জুনেদ আহমদ, সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আয়ুব বখত জগলুল, জেলা আওয়ামীলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নূরুল হুদা মুকুটসহ বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাবৃন্দ, রাজনীতিবিদ ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ।
ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দেশের ৬ জেলার আরো ৮টি সেতু উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। সুনামগঞ্জের আব্দুজ জহুর সেতু ছাড়াও মাদারীপুর জেলায় ৪টি ব্রিজ, সিলেট জেলায় নবনির্মিত গোলাপগঞ্জ-বিয়ানিবাজার সড়কে কুশিয়ারা নদীর ওপর চান্দেরপুর ব্রিজ, পটুয়াখালী-কুয়াকাটা মহাসড়কে শেখ রাসেল ব্রিজ, কক্সবাজারের চকোরিয়া-বদরখালী-মহেশখালী সড়কে বেতাখালী ব্রিজ এবং গাইবান্ধা জেলার গাইবান্দা-নকাইহাট-গোবিন্দগঞ্জ সড়কে করতোয়া নদীর ওপর বরদহ ব্রিজ উদ্বোধন করেন।
এদিকে ২০১২ সালে মহাজোট সরকারের সময় সুরমা সেতু প্রকল্পটি সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা (এডিপি) থেকে বাদ পড়ে যায়। এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্পটি আবারও এডিপিভুক্ত করার দাবি জানান সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সেই সময়ের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব মতিউর রহমান। প্রকল্পটি এডিপিভুক্ত করা না হলে সংসদ থেকে পদত্যাগেরও হুমকি দেন তিনি। তাঁর প্রচেষ্টায় কিছু দিনের মধ্যে আবারও এডিপিভুক্ত হয় প্রকল্পটি। নির্মাণ সামগগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় সর্বশেষে সেতুটির নির্মাণ ব্যয় দাঁড়ায় ৭১ কোটি টাকা। গত ২৩ জুন সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ বাজেট বক্তৃতায় সেতুটির নামকরণ জননেতা আব্দুজ জহুর-এর নামে নামকরণ করার দাবি জানান। পীর মিসবাহ এ ব্যাপারে ২৪ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন এবং ২৭ জুন পীর মিসবাহ এমপি সেতুটি আব্দুজ জহুরের নামে নামকরণের জন্য আবেদন করেন। গত ৬ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব (পিএস-২) ড. নমিতা হালদার সেতুটি জননেতা আব্দুজ জহুরের নামে নামকরণে প্রধানমন্ত্রীর নিদের্শনার অনুলিপি সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট পীর মিসবাহকে প্রদান করেন।
অন্যদিকে একটি সেতুর কারণে পরিবর্তনের জোয়ারে ভাসছে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জেলা সুনামগঞ্জ। সুনামগঞ্জ জেলা সদরের মল্লিকপুরস্থ এলাকায় সুরমা নদীর উপর নবনির্মিত আব্দুজ জহুর সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ প্রতিক্ষার অবসান হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকাল ১১টার দিকে গণভবন থেকে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক সম্মেলন কক্ষে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আব্দুজ জহুর সেতু উদ্বোধনের মধ্যদিয়ে নদীর দুই তীরের জনপদের মধ্যে সেতুবন্ধন স্থাপন করা হয়েছে। জানা গেছে, সেতুটি উদ্বোধন হওয়ায় জেলা সদরের সাথে মিলন ঘটলো হাওড় অধ্যুষিত বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, জামালগঞ্জ ও ধর্মপাশা উপজেলার ১৫ লক্ষাধিক মানুষের। ফলে শিক্ষা, চিকিৎসা, কর্মসংস্থানসহ বিভিন্ন সুযোগ বাড়বে এই জনপদের। এ প্রসঙ্গে সুনামগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট তৈয়বুর রহমান বাবুল বলেন, এই জনপদের মানুষের প্রাণের দাবি ছিল একটি সেতু। যুগের পর যুগ মানুষকে ফেরি ও ট্রলারের মাধ্যমে খরস্রোতা সুরমা নদী পার হতে হতো। দুর্ভোগ ছিল নিত্যসঙ্গী। সেতুটি উদ্বোধন হওয়ায় দুর্ভোগ লাঘব করে অবহেলিত এই জনপদের যোগাযোগের দ্বার উন্মোচন হয়েছে। সেতুবন্ধন তৈরি হয়েছে এপার-ওপারের মানুষদের মধ্যে। তাহিরপুর উপজেলার তরং গ্রামের বাসিন্দা ওসমান গনি তালুকদার বলেন, আব্দুজ জহুর সেতুটি চালু হওয়ায় সামাজিক, পর্যটন ক্ষেত্রের পাশাপাশি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে এই অঞ্চলের অর্থনীতির ওপর। যোগাযোগ ব্যবস্থায় আসবে অভূতপূর্ব বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
উদ্বোধনের পরে প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, জনপ্রতিনিধিবৃন্দ সেতুটি পরিদর্শন করেন। এ সময় হাজার হাজার মানুষ উৎসব মুখর পরিবেশে সেতুটিতে সমবেত হয়।
উল্লেখ্য, সুনামগঞ্জ সড়ক ও জনপথ বিভাগ জানায়, ২০০৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর সাবেক অর্থমন্ত্রী মরহুম এম সাইফুর রহমান সুরমা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। সে সময় এটির নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ২৩ কোটি টাকা। দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সাড়ে ৭ কোটি টাকার কাজ করানোর পর বন্ধ করে দেয়া হয় প্রকল্পটি। ২০০৬ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ৬৪ কোটি ৫৪ লাখ ৩১ হাজার টাকা মূল্য পূণ:নির্ধারণ করে আবারও চালু হয় প্রকল্পটি।